তন্দ্রা

সন্ধ‍্যার মূরতি -
মম চিত্তলোক সুপ্তি
নিল আজি কাড়ি
প্রকৃতির ছায়াবেশ ছাড়ি।
অফুরান মুক্তির আনন্দে
মম প্রাণ নিখিল অলিন্দে
হরষিত কলহাস‍্য তুলি
সব উপহাস হাস‍্য ভুলি
জীবনের সাথে দেয় তালি
প্রেমভরে করে গলাগলি।

মম নিঃশব্দের অন্তরালে
মৌনতার তুহিন
হঠাৎ সূর্যালোকে গ'লে
বয়ে চলে কলনৃত‍্যে
ফেনিল তরঙ্গ তোলে
তোলে ধ্বনি কলকল-- মম চিত্তে।

আজিকে হৃদয় মম
বাঁধভাঙা নদীবেগ সম
শতপাকে ঘুরিয়া দিশাহারা
নিমিখে পায় সে জীবনের ইশারা।

আজি পরাণ বিভোল
পেয়ে বাতাসের আলোল দোল
বীণাবিনিন্দিত পবনস্বননে
মম নিঃশব্দ মনবনে
জাগে সুর
হয়ে ওঠে অবসর মেদুর।

নিজের পরাণে হঠাৎ একি,
আলো জ্বলে ঝিকিমিকি!
সহসা এত কোলাহল প্রাণে
বাহির ধরার গানে
প্রাণে জাগে সাড়া
অন্তরে আমি দারুণ ছন্নছাড়া।

মোর প্রাণে যেনবা আজিকে ভোজ
যেনবা আজিকে ধরণীতে নওরোজ
যেনবা আজিকে মিলন বাসর মম
শোভিছে ধরণী স্বরগ কানন সম।
বিজনে গাহিছে খগ
সমীরণ ভেদী উঠিয়াছে নগ
ফুটিছে কুসুম কাননের মাঝ
মধুর হইয়া নামিয়াছে সাঁঝ।

আজিকে ভোরের অমল আলোয়
নেচে ওঠে মন ধরার ধূলোয়
লুটাবারে চায়, ছুটিবারে চায়
শ‍্যামল বনের ছায়।
আজি দূর নীলাকাশে
চেয়ে দেখি সহাস‍্যে
পেঁজা তুলোর মতো মেঘ
ওড়ে পেয়ে সমীরণ বেগ
যেখানে পেল মান ছাড়া
নৃত‍্যে নৃত‍্যে দিশাহারা।

আজি এই জরজর প্রাণে
এসেছি রাতের জড়িমা ঝেড়ে
এসেছি প্রভাত নীড়ে
এখানে বিহগ-ললিত গান
জীবনের কলতান
গুঞ্জরিছে অজুত কলস্বর
শোভাতে সকলে শোভে--
সকলি মধুরতর।

আজি মুখর মোর রাতি
গগনে বিভোর চন্দ্রভাতি
নিবারিছে মধুরে সন্তাপ
করিছে সহাস‍্যে সদালাপ।
পেয়েছি জীবনের নিঃশেষ অধিকার,
তারে খুলে দিতে হবে দ্বার;
প্রাণ কল্লোল শুনি বাহিরে
দিনান্তের প্রহরে
নেচে ওঠে মন
পাই প্রভাতের নিমন্ত্রণ।

অবষণ্ন তনুদেহ মোর
উচ্ছ্বাসে জরজর
আলোকের চুম্বন-বন্ধনে
পুলকিত থরথর কম্পনে
ছুটে যায় দিগ্বিদিক--

মোর চিত্ত আজি ক্ষ‍্যাপা আগন্তুক;
জীবনের প্রান্তরে ভুলেছে সব
ফেলে রেখে এসেছে তার মৃত‍্যুর শব।
(২০০৬)
ঘুম আবাহন

আয় আয় ঘুম আঁখিপাতে চুম
হানিতে নিবিড়।
আয় হৃদি ছায়ে বিহ্বল বায়ে
ভেদিয়া তিমির।

আয়রে অথির পরিয়া আপীড়
অভিসার সাজে।
আজিকার সাঁঝে পশিবি নিবিড়
চিত্তপুরী মাঝে।

আয় আয় ঘুম স্বপন কুসুম
ফুটাবি হিয়ায়।
আয় এই বাটে মনরাজ‍্যপাটে
মেঘের খেয়ায়।

মানস সরসী টলাবি রূপসী
লীলাভরে আয়।
টলমলে নীর ভামিনী সুধীর
আয়রে হেথায়।
(২০০৬)
বিহ্বল চাতক

দিবা চলে যায় বিহগ পাখায় সন্ধ‍্যা নামে,
কাহার তৃষায় ঘুম টুটে যায় নিশীথ যামে?
কাহার চরণ পরাণে বাজায় নূপুর বিলাপ?
মন কাঁদে হয় তবুও সাজায় কুসুম কলাপ।
(২০০৭)
সাঁঝবেলা
ডুবিল তপন ছাইল ভুবন আঁধার জালে
এলো সাঁঝবেলা লুলিত আঁচলে ইন্দু ভালে।
(২০০৭)
সখি আবাহন
বেলা হলো ভোর ভরিয়া আচোর
তুলিবি কি ফুল?
তবে ত্বরা চল হেসে খলখল
তুলিবি মুকুল।
কত যে কুসুম ফুটেছে দেখিবি
হইয়ে বিভোর
শাখায় শাখায় শেফালি বকুল
ভরিবে কোচড়।
(২০০৭)
কৃপাভিক্ষা

ক্রীতদাস আমি তব নিতান্ত কাতর!
কৃপা যদি নাহি করো অধমের পর,
কোথা লভিব শরণ ত্রিভুবন মাঝে?

যেথা তব রাজদণ্ড উজলিয়া রাজে,
তারি তুচ্ছ প্রজা হয়ে কাটাই জীবন
ইহার অধিক কিছু নাহি প্রয়োজন।
(২০০৮)
ঈপ্সিত

করি হর্ষ বরিষণ, কে গো তুমি সুলোচন
এমন মধুর রূপে, রাজিলে মরম তলে?

তোমাসম কেহ নাহি, এতদিন দিবাযামী
দেখেছি যে সুস্বপন, আজিকে পাইল তাহা
মূরতি।

আজিকে মরমতলে ফুটিল কুসুম কত
স্বরগ কাননসম পাখি করিল কাকলী।
চারিদিকে নবরূপে পুরাতন সাজিতেছে
বিপুল বরণ লয়ে যেন সবে খেলিতেছে
আজি।

আজি মোর যত সাধ, শরম-জড়িমা-বাঁধ
দিবালোকে পেল ছাড়া, ছড়ায়ে পড়িল সবে
কত দিকে কত রূপে; নেই তার সংখ‍্যা সীমা।
সকলি ব‍্যাপিছে ধীরে, চেনা-অচেনার ভীড়ে,
দিবসের কোলাহল ছেড়ে।

আজিকে জীবন মম সুধারসে ভরোভরো
নাহি সেথা অনাদর, নাহি তার অবহেলা
কোনো।
(২০০৮)
সন্ধ‍্যারতি

ফুল্লরূপী সাঁঝবেলা রজনী নিলীন,
তোমাতে শরণ লভে জগজন দীন।

তোমারি আঁচলতলে পূর্ণশশী ঝলে
যেন মোতি হার আকাশ অঙ্গনা গলে,

যেন চারু হাসি হাসে নবফোটা কলি
হের ধরাতলে কোথা তার তুল!
(২০০৮)
সমাধির মতো রাত

অবশেষে পৃথিবীতে নামিয়াছে রাত;
গভীর প্রশান্তি লয়ে, দীঘির জলের
মতো নিস্পন্দ-- শীতল। থেমে গেছে যত
ছিল কাজ। জগতের সব প্রয়োজন
সাঙ্গ হলে পরে, হেমন্তের বেলা শেষে
কেবল রিক্ততা কান্না হয়ে আসে; সব
বাস্তবতা যায় মুছে, কেবল ধূসর
অপার আকাশ থাকে সম্মুখে আমার।

সমাধির মতো শব্দহীন নির্জনতা
ভীড় করে মোর পাশে, শিয়রে-- শয‍্যায়--
অথর্ব, বীভৎস, মৃত‍্যুসম অচঞ্চল
আবেগরহিত দুটি চোখ মেলি, দেখি
নিজেকেই;-- বাহিরে তখন কী অধীর
আকুলতা-- কল্লোলিত উজ্জ্বল সকাল।
চট্টগ্রাম সেনানিবাস, ২০০৮
রজনী আগমন

সোনার চামর দুলায়ে গোধূলি ধনি
কোথা গেল হেন আঁধার আচল টানি!
হায় নিশামুখ! হায় রে তামস তনু
রূপ তব গেছে আছে শুধু সুররেণু।
(২০০৮)

খরা

বাদল বধূর মুখর ঝারি কৃপণ কেন!
জলধারা নেই, বিরূপ বুঝি হায়, গো কেনো?
নিথর তোমার মেঘরথ যে বড় চঞ্চলা
মুখর মোদের মুখের ভাষা অতি উতলা।

নেই কি তোমার করুণা এই ধরার পরে,
হা! কহ গো, বিরূপ হেন কিসের তরে?
শুকিয়ে গেছে সলিল লীলা নয়ন কোণে?
কোন্ নিদয়ার হিম হিয়ার নিঠুর বাণে?

নেই বুঝি তাই জলের ধারা কেবল খর
রোষবহ্নি ঝরে গগন হতে কোপনতর?

বিগত বোশেখ, গীরিশ এলো ভীষণ দাহ
কাল বোশেখের ঝড় কই লো জ‍্যৈষ্ঠ মাহ।
এমন সজল দিনের শেষে আষাঢ় এলো
মেঘ ভেষে যায় বৃষ্টি না হয় বাদল ম'লো।

মগন মনের সকল কোণে তোমার স্মৃতি
আষাঢ় আঁধার মেদুর মেঘ বরষষা গীতি।
হায় বুঝি শেষ হয় না ক' এই খরার দিন
হিয়ায় মোদের বাজে তবু যে বাদল বীণ!
(ঢাকা, ২০০৯)
পুষ্পোৎসব

ফুলবাগে আজ উৎসব বুঝি?
শাখায় শাখায় ফুলকুঁড়ি গুঁজি
কুুসুমিত যত বনতরুরাজি।

শোভাতে ফুলের ঝলসে কানন,
আঁখি ঢুলে আসে আলসে চেতন-
ফুলশীধুমদে মোদিত পবন;
উলসিত তাহে নিপীত আনন।
(২০০৯)
বর্ষা

সজল বাদল ঝরিল রে ঝরঝর,
বনকুঞ্জনীড় কাঁপিল রে থরথর।

কাঁপিল কপোত ধবল পালক তলে,
ঝাপিল গগন সঘন মেঘের দলে।

শিথানে পশিল মেদুর মেদিনী ঘ্রাণ,
শিকর-থকিত জ'লো বায়ু শনশন।

দল বেঁধে ওই হাঁসেরা পড়িল জলে,
বারি বুদ্বুদ আহ্লাদে মাখিলো কোলে।
(২০০৯)
বসন্ত ঋতু

মাধবী মালিকা লয়ে আসিল মাধব,
সরোবরে সরসিজ কুসুমে আসব্।
উরগ উন্মদ তায় ফুলমধু আশে
দয়িত দগধে আজ দয়িতা সকাশে।

আতর সুরভে আজ আকুল আক্রীড়
ললামে ললিত তনু শিরেতে আপীড়।
মধুমাসে মধু্আশে অধীর ভুবন
চপল পরাণ যাচে মালঞ্চ পবন।

মঞ্জরে নব মঞ্জরি পরাণে-বাহিরে,
নন্দিত জগজন ঋতুরাজ বিহারে।
(২০০৯)
নিবেদন

যে কথা কহিতে তুমি চাও শুধু মোরে,
সে তো নহে অজানা আমার; হেমন্তেরে
সঙ্গোপনে সে কথা আমিও কয়েছি যে
বহুবার; চাঁদের আড়ালে থেকে নিজে।

এই চাঁদ! এই পথ! লতা-পাতা-নীড়,
এই যে চাঁদিমা ছটা কেমন নিবিড়
এলায়ে পড়েছে চুপে রজনীল পরে
ঘোরালো ঘোলাটে ভাতি ধরণীর ক্রোড়ে।

নিশীথ নীরব তায় সুপ্ত চরাচর
ঝরে শুধু একঘেয়ে নীহার ঝর্ঝর।
হেথায় মানসী মোর মেঠো বসবাস
তুমি কী কহিবে এর সুদূর প্রবাস!
(২০১০)
দুই নয়নে

কোন নয়নে দেখবো তোরে?
আমার বুঝি অনেক নয়ন!
দুই নয়নে দেখি তোরে;
ভরসা আমার মনের গহন।
(২০১১)
উৎকণ্ঠা
দিবা অবসান গোধূলি পুলিনে ওই,
ডোবে দিনমণি প্রখর দারুণ, সই;
ত্বরা করি চল ফিরি এইবেলা, হায়!
কেমনে ফিরিব রবি যদি নাহি ভায়?
(২০১১)
সাধ

কী বুনো স্বপ্নের সাধ বাঁধিলো কুলায়--
প্রাকারে প্রাকারে ওড়ে নিষেধ কেতন,
তবু কোন স্বপ্নলীন দীপ্র সম্মোহন
নিরুচ্চারে তুলে ধরে নবীন জীবন,
আর কোন জগতের প্রগাঢ় প্রচ্ছ্বায়?

আজ মনে হলো হই ঘরছাড়া। বুনো
জন্তুর মতো তীব্র ভয়ে দিগন্তর ছুঁই,
ছুঁয়ে আসি অকাতরে তাবৎ বিভুঁই-
নয়তো ভীষণ রকম দাঙ্গাবীজ রুই।

তারপরে নিরুত্তাপে জালাই প্রাচীন
খাণ্ডবের আগুন-- অথবা, নিলীন
শাদ্বলে মুখ ঘসে হই, বুনো হরিণ।
(২০১৩, ১২০/খান জাহান আলী হল)
ফেরা

অনেকখানি পায়ে হেঁটে,
রিকশা এবং ভ‍্যানে চেপে,
পেছন বাসে সওয়ার হয়ে--
শেষমেষ ঠিক এলাম ফিরে;
তোদের ঘরে।
অনেকখানি শঙ্কাভরা বুকটি চেপে,
বাহারি এক জামার তলে,
হাতে ঝোলা পলকা ঠোঙা
বাতাসে খুব ভাসিয়ে নিয়ে;
তোদের ঘরে।
(২০১৪)
অভিসার

নিসাড়াতে ডুবে গেলে চাঁদ, প্রেতসম
মোর জানালায় কোন্ মেয়ে এলো নেমে?
তারা সেজ তুলে চুপিচুপি ঝরিল সে,
শিশিরের মত...
(২০১৪, ১২০/খান জাহান আলী হল)
ডাক

এখন অনেক বেলা
ঘুমের পহর
ভেঙে গেছে মেলা আগে।

আলোর নহর
আনচান করে করে মুখভার রোদ
হলো বিকেলের।

এখন বিকেল পোনে পাঁচ ছুঁইছুঁই -
এমন সময় ডাক দিবি না তুই?
(২০১৫, ১২০/খান জাহান আলী হল)
ভুলে

হেথা কেনো তুমি? ধরণীর প্রান্ত চুমি
ওঠে যেথা প্রভাত তপন,
যেথা নিত‍্য নব আয়োজন
রজনীর দুয়ার খোলে।
তুমি সেথা এলে কি ভুলে?
(২০১৫)
মিতভাষণ

অল্প কথা স্বচ্ছতোয়া ছিপছিপে এক নদী
জলের আড়াল অল্প তাতে সিনান করবি যদি
ঘোলা জলের বাণের দাপট তুলবে নাক' কাঁপন,
বুকের গহন স্পষ্ট হয়ে করবে তোরে আপন।
(২০১৬)
যখন নগড় পোড়ে

ব‍্যালকনি কুয়াশা-নিবিড়; ঝিমধরা।
দু'হাত সামনে উড়ছে হিমের কণা।

অরণ‍্যের নিস্তব্ধতা সন্তর্পণে এসে,
জাকিয়ে বসেছে এই অঘ্রাণের শীতে।

লেপের উষ্ণতা ফেলে, কীসের আশ্লেষে
থির থির নিথর দাঁড়াই ব‍্যালকনিতে?

কোথায় নগড় পোড়ে? কোন্ অন্তিমাশা
আলো জ্বেলে যায় আমার শীতের রাতে?

যে নগর গড়ে ওঠে ক্রমে ক্রমে; ঘাম,
আর যুগব‍্যাপী শ্রমে; সে নগরও পোড়ে--
খরতর কোপে আর লোভে, তার তাপ
সন্তাপ হয়ে আসে-- আমার ব‍্যালকনিতে।

দু'হাত সামনে উড়ছে হিমের কণা
ব‍্যালকনি কুয়াশা নিবিড়; ঝিমধরা।
                   (২০১৬, প্রান্তিকা/খুলনা) 
২০১৬ সালের শেষের দিকে তখন বার্মার সেনাবাহিনী রাখাইনের গ্রামগুলোতে হত‍্যা এবং ধ্বংস চালাচ্ছিল।